স্থাপত্য একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর সৃজনশীল পেশা। একসময় এ পেশা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ততটা ধারণা না থাকলেও বর্তমানে মোটামুটিভাবে এ পেশার প্রসার ঘটেছে। রাজধানী এবং এর বাইরে সরকারি ও বেসরকারি বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য অনুষদ থাকায় অধিক সংখ্যক মানুষ যেমন এ পেশা সম্পর্কে অবগত হচ্ছে, তেমনি প্রতিবছর স্নাতক স্থপতিদের সংখ্যাও বাড়ছে। আবার অন্যদিকে ঢাকা শহরের ক্রমবর্ধমান আবাসন চাহিদার কারণে গড়ে ওঠা হাউজিং কোম্পানিগুলো এক্ষেত্রে কাজের সুযোগ তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। এ অবস্থায়, এ পেশার পরিবেশ তৈরি ও শৃংখলা রক্ষার জন্য সুনিয়ন্ত্রিত ও সমন্বিত পদ্ধতির প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। নতুবা এই ক্ষেত্রে অনিয়ম ও বিদ্যমান নীতিমালা ভঙ্গের ঘটনা ঘটবে এবং তার ফলে রাজধানীসহ সারাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা বাড়বে।
উন্নত বিশ্বের দেশগুলিতে একটি সুনিয়ন্ত্রিত পদ্ধতির মাধ্যমে সুস্থ পরিবেশ বিরাজমান। নির্দিষ্ট পদ্ধতি সেখানে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত আছে। ফলে সাধারণ মানুষ যেমন জবাবদিহিতামূলক পদ্ধতিতে এ সেবা গ্রহণ করে লাভবান হচ্ছে তেমনি তৈরি হচ্ছে এই পেশার ব্যাপক ক্ষেত্রে। এখন আমাদেরও সময় এসেছে একটি যথাযথ পদ্ধতি প্রণয়ন করবার। ২৫শে ফেবরুয়ারী ২০০৬ (মহাখালীতে ফিনিক্স ভবন ধ্বস) অথবা ১০ই এপ্রিল ২০০৫ ( সাভারে স্পেকট্রাম গার্মেন্টস ভবন ধ্বস)-এ ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর হাত-পা গুটিয়ে থাকা বস্তুত আত্মহত্যার সামিল। তাই এই পরিস্থিতি ঠেকাতে স্থপতি ও প্রকৌশলী এবং ভবন নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে একটি কার্যকর সমন্বিত পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা উচিত বলে আমরা মনে করি।
বর্তমানে কোন ভূমির মালিক ভবন নির্মাণের জন্য বাঁধাধরা কোন পদ্ধতি অনুসরণ করেন না। যিনি যেভাবে পারছেন সেভাবেই কোন না কোন সূত্র ধরে স্থপতি ও প্রকৌশলীদের কাছে যাচ্ছেন এবং তার নকশা বা ডিজাইন সংগ্রহ করছেন। অধিকাংশ ভূমি মালিক যেমন পুরোপুরি যোগ্যতা বিচার না করেই যেকোন নকশাকারের কাছে যাচ্ছেন এবং যেকোন পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজ করাচ্ছেন, তেমনি অনেক ব্যক্তি নিজেকে স্নাতক স্থপতি বা প্রকৌশলী পরিচয় দিয়ে কাজ করে ভোক্তাশ্রেনীকে প্রতারিত করছেন। আবার অনেক ভবন-উপদেষ্টা যথাযথ পারিশ্রমিক না পাওয়ার কারণে হয়তো কাজটা ততটা গুরুত্ব দিয়ে করছেন না। অনেকক্ষেত্রে যথাযথ পারিশ্রমিকের অভাবে যথার্থভাবে নির্মাণ কাজের তদারকি করছেন না। ফলে অনেকক্ষেত্রে নকশা নিয়মমাফিক সঠিক থাকলেও নির্মানের সময় এর প্রয়োগ হচ্ছে না। অন্যদিকে রাজঊক স্বল্প লোকবলের কারনে সঠিকভাবে ভবন তদারকি করতে পারছে না। এবং বিরাজমান এসব পরিস্থিতির সুযোগ হিসেবে কিছু অসৎ ভবন-মালিক নিয়ম বহির্ভুতভাবে ভবন তৈরী করছেন, যার মর্মান্তিক শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। কেবল ভেঙে পড়লেই আমরা জানতে পারি তাদের অপকর্মের কথা, সরব হয়ে ওঠে স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো। সঠিক পরিসংখ্যান জানা না থাকলেও এ ধরনের ভবনের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়।
যখন একজন ভূমি মালিক তার কাঙ্ক্ষিত ভবনের নকশা প্রণয়নের কাজে স্থপতি বা প্রকৌশলী বা কোন উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করবেন, তখন নির্দিষ্ট ফিসের মাধ্যমে রাজউক বা স্থপতি ইনস্টিটিউটের নির্ধারিত ফর্মে ভূমি-মালিক ও উপদেষ্টা পরস্পরের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হবেন। ফলে কখন, কোথায় কোন ভবন নির্মিত হচ্ছে তা শুরু থেকেই রাজউকের নজরদারির আওতায় থাকবার পাশাপাশি ভবন মালিকগণ দক্ষ ও যোগ্য উপদেষ্টার মাধ্যমে নকশা প্রণয়নে বাধ্য হবেন। ঐ উপদেষ্টা কর্তৃক প্রণীত নকশার ভিত্তিতে রাজউক ভবনটির প্রাক-ছাড়পত্র প্রদান করবে। যার দ্বারা মালিকগণ ভবন নির্মাণের অনুমতি লাভ করবেন এবং একইসঙ্গে ছাড়পত্রে নির্ধারিত উপদেষ্টার তত্ত্বাবধানে ভবনটি নির্মাণের নির্দেশ থাকবে।
যেহেতু রাজউকের লোকবল সীমিত, তাই রাজউকের নিবন্ধনকৃত স্থপতি ও প্রকৌশলীগণই হবেন নির্মাণ তত্ত্বাবধানকারী রাজউক প্রতিনিধি। ফলে স্বল্প লোকবল থাকা সত্ত্বেও রাজউক বাহ্যিক সহায়তা ব্যবহার করে যেমন অনিয়ন্ত্রিত ভবন নির্মাণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে তেমনি উপদেষ্টাদের কাজের পরিধিও বিস্তৃতি লাভ করবে। ভবন নির্মাণ শুরু করার পর মালিকগণ নির্দিষ্ট সময় ভিত্তিক নির্মাণ কাজের অগ্রগতিমূলক প্রতিবেদন দাখিল করবেন। পরবর্তী সময়ে ভবন নির্মাণ পরিসমাপ্তির পর নির্মিত ভবনের নকশাসহ (As-Built Drawing) ভবনটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করবেন। এসবের ভিত্তিতে অনাপত্তিপত্রসহ ভবনটির চূড়ান্ত ছাড়পত্র রাজউক কর্তৃক প্রদত্ত হবে। নকশা প্রণয়ন থেকে ভবন নির্মাণ পর্যন্ত মালিক এবং উপদেষ্টা উভয়েরই অপরপক্ষ সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকলে রাজউক বা স্থপতি ইনস্টিটিউট তা মধ্যস্থতা করবে।
প্রস্তাবিত এই পদ্ধতিতে নির্মিত ভবনসমূহ যেমন উপদেষ্টাদের মাধ্যমে রাজউকের তদারকি ও নজরদারির আওতায় থাকবে তেমনি দীর্ঘমেয়াদি চলমান একটি পদ্ধতির কারণে অসাধু ভবনমালিকগন ঝুকিপূর্ণ ভবন নির্মাণের সুযোগ হারাবে। সর্বোপরি, আমরা মনে করি প্রস্তাবিত এই পদ্ধতির ফলে যোগ্য ও দক্ষ উপদেষ্টার মাধ্যমে রাজউক সৃজনশীল ও টেকসই ভবনের মাধ্যমে ঢাকা মহানগরীকে নিরাপদভাবে বাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে পারবে।
—————————-
[ লেখকঃ স্থপতি মুহাইমিন শাহরিয়ার, প্রধান স্থপতি, ডিকন্সট্রাকশন আর্কিটেক্টস]
“২০০৬ সনে দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয়েছিল”